আরশীনগর প্রতিবেদক,
ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে মুর্শিদাবাদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ অবিভক্ত বাংলার ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদ, বা ‘হাজারদুয়ারী প্যালেস,। প্রতিমাসে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটে এই হাজারদুয়ারী বা মিউজিয়াম দর্শনে। নবাবী আমলের কালের সাক্ষী হয়ে স্থাপনাটি আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ এলাকায়। এই মুর্শিদাবাদ যেন আজ ইতিহাসের এক ভান্ডার। এর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসে বাংলার নবাবী আমলের অমূল্য সম্পদ।
তবে কালের বিবর্তন ও সংরক্ষণের অভাবে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্মৃতিসমূহ বিলীন হয়ে গেছে। তাছাড়া এই মুর্শিদাবাদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন (১৭৩২-১৭৫৭ সাল) নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ওরফে মির্জা মোহাম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলার নির্মম স্মৃতি এবং ভারতবর্ষের পরাধীনতা। একটু পেছনে ফিরে বললে, ১৭০০ শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের আগ পর্যন্ত বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার নবাবদের রাজধানী ছিল এই মুর্শিদাবাদ। এখানেই রাজত্ব করতেন প্রতাপশালীসব নবাবরা। তখন মুঘলদের অধীনে সুবাহ বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। ওই সময় সম্রাট ঔরঙ্গজেব মুর্শিদকুলি খাঁকে বাংলার দেওয়ানের পদে নিযুক্ত করেন। মুর্শিদকুলি খাঁর তখন নাম ছিল করতলব খাঁ। করতলব খাঁর সততা ও দক্ষতায় সম্রাট ঔরঙ্গজেব মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভাগীরথী গঙ্গার তীরে মকসুদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের অনুমতি দেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে ‘মুর্শিদকুলি খাঁ’ উপাধি এবং মকসুদাবাদের নাম পাল্টে মুর্শিদাবাদ রাখারও অনুমতি দেন। পরে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হলে ১৭১৭ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী স্থানান্তর করেন এবং তাঁর নিজের নামানুসারে নতুন এই রাজধানীর নামকরণ করেন মুর্শিদাবাদ। ততদিনে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার সুবাহদার এবং পরবর্তীতে তিনিই হয়ে ওঠেন বাংলার প্রথম নবাব। আবার এই মুর্শিদাবাদের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পলাশীর যুদ্ধে রক্তাক্ত পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার আকাশে অস্তমিত হয় শেষ স্বাধীনতার সূর্য। ওই যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভ নবাব সিরাজকে পরাজিত করে কলকাতার দখল নেয় এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন সূচিত হয়। ফলে বাংলাসহ ভারতবর্ষ পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয় অন্ততঃ ২০০ বছরের জন্য। সেই থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে উঠে ইতিহাসের এক পান্ডলিপি। এসব কারণে ভ্রমণ পিপাসু দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে মুর্শিদাবাদ এবং নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার স্মৃতি-নিদর্শন সম্পর্কে জানার ও দেখার আগ্রহ অসীম। তবে হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদ বা হাজার দুয়ারী প্যালেস এর সঙ্গে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কোন সম্পর্ক নেই। অনেকের ভূল ধারণা, হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার স্মৃতি বা তিনিই এটি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। আসলে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মৃত্যুর বহু বছর পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যুগে তৈরি করা হয় এই হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদ। বলতে গেলে মুর্শিদাবাদের মাটি, আর আকাশ-বাতাস ছাড়া এখানে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার স্মৃতিচিহ্ন-নিদর্শন বলতে তেমন কিছুই নেই। প্রায় ২শ’ বছরের ইংরেজ শাসন আমল, অনাদর-অবহেলা আর ভাগীরথী নদীর ছোঁবলে নবাবের স্মৃতি-নিদর্শন সমূহ বিলীন হয়ে গেছে। নবাব সিরাজের প্রাসাদের নাম ছিল ‘হীরাঝিল প্রাসাদ,। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রাসাদের তিনতলায় ছিল বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর। দোতলায় ছিল দরবার হল, পাঠাগার, অতিথিশালা এবং একতলায় ছিল অফিসঘর ও গাড়ি রাখার জায়গা। এর সবই চলে গেছে ভাগীরথী নদীর পেটে। ব্রিটিশ যুগে বাংলার এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হলো আজকের এই হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদ। যা অবিভক্ত বাংলার নবাবি আমলে স্থাপত্যকলার এক উজ্জ্বল প্রতিফলন। বিশাল এই রাজপ্রাসাদের প্রত্যেকটি হলঘর হলো অনুপম সৌন্দর্যের আলোকে সজ্জিত। এটি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মৃত্যুর অন্তত ৮০ বছর পর তৈরি করা হয়। ইউরোপীয় স্থপতি দিয়ে ১৮৩৭ সালে তিনতলা উচ্চতা বিশিষ্ট বর্তমান হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদটি তৈরি করেন মীরজাফরের বংশধর নবাব নাজিম হুমায়ুনজা। ১৮২৯ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ৮ বছর পর ১৮৩৭ সালে তা শেষ হয়। এটি ইতালীয় শৈলীতে নির্মাণ করা হয়। ওই সময় প্রাসাদটি নির্মাণে হুমায়ুনজা ব্যয় করেন প্রায় ১৮ লাখ টাকা। এর মূল স্থপতি ছিলেন ডানকান ম্যাকলয়েড। তাঁর সহযোগী ছিলেন বাঙালি স্থাপতি সবুর মিস্ত্রী। হাজারদুয়ারীর ৯০০টি দরজা হলেও এর আরও ১০০টি কৃত্রিম দরজা রয়েছে। তাই প্রসাদটির নামকরণ হয়েছে হাজার দুয়ারী। এ প্রাসাদের একতলায় ছিল বিভিন্ন অফিস ও ঘোড়ার গাড়ি রাখার জায়গা, দোতলায় ছিল পাঠাগার, দরবার হল ও অতিথিশালা এবং তিন তলায় ছিল নবাব ও বেগমদের থাকার জায়গা। একতলার সামনে রয়েছে বিশাল সিঁড়ি। এই সিঁড়ি প্রাসাদ এর দরবার হল পর্যন্ত উঠে গেছে। প্রাসাদের সামনে রয়েছে সুন্দর নকশার কাজ সম্বলিত গোলাকার স্তম্ভ। সিঁড়ির দুই পাশে রয়েছে ব্রিটিশ রাজ্যের প্রতীক সিংহের প্রতিমূর্তি আর তার পাশে দুটি ছোট সেলামি কামান। মুর্শিদাবাদের প্রাচীন স্মৃতি অপরুপ গথিকশৈলীর এই প্রাসাদ বর্তমানে একটি মিউজিয়াম। হাজারদুয়ারী দর্শনার্থী মানুষের মাঝে কৌতূহলের যেন অন্ত নেই। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মুর্শিদাবাদ আসেন প্রাসাদটি দেখতে। এটিকে নবাবি আমলের শেষ নিদর্শন হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। নবাবী প্রথা বিলুপ্তির পর দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়েছিল এই হাজারদুয়ারী। অবশেষে ভারত সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ এটিকে অধিগ্রহণ করে সেখানে একটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করে। প্রাসাদটির নিচতলায় অস্ত্রাগারে অন্তত ৭শ’ দুর্লভ অস্ত্র রয়েছে। যেখানে পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রও স্থান পেয়েছে। রয়েছে ওইসময় নবাবদের ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র যেমন, তরবারী, বহু নল বিশিষ্ট বন্দুক, বিভিন্ন ধরনের কামান, রাইফেল, বিভিন্ন ধরনের ছোরা প্রভৃতি। দোতালায় আর্ট গ্যালারিতে রয়েছে মুর্শিদকুলি খানের মার্বেল পাথরের সিংহাসন। সিরাজ-উদ্দৌলার রুপার পালকি, হাতির দাঁতের পালকি, বিভিন্ন চীনা মাটির তৈরি আসবাবপত্র, মহারানী ভিক্টোরিয়ার উপহার দেয়া ১০১ টি বাতি যুক্ত সুদৃশ্য ঝাড়বাতি। তৃতীয় তলায় লাইব্রেরীতে অনেক ধর্মপুস্তক, তৎকালীন সাহিত্য তাম্রলিপি, ঐতিহাসিক চুক্তিপত্র, প্রয়োজনীয় দলিল দস্তাবেজ, বৈদেশিক ভাষায় গ্রন্থ, সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজলের লেখা আইন-ই-আকবরীর পান্ডুলিপি, বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুনুর রশিদের নিজ হাতে লেখা কোরআন শরীফের কপি ইত্যাদি দুর্লভ সংগ্রহ আছে। এছাড়াও বিখ্যাত শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবি আছে এই জাদুঘরে। সব মিলিয়ে এই হাজারদুয়ারী রাজ প্রাসাদে অন্তত এক হাজারেরও বেশি দর্শনীয় প্রত্নতাত্বিক জিনিস রয়েছে। বলে রাখা প্রয়োজন যে, প্রাসাদের অভ্যন্তরে এইসব প্রত্নতাত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের ছবি ধারণ সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে সুন্দর ও সুসজ্জিত বাগান।
হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদের টাওয়ার ঘড়ি: প্রাসাদের সংযুক্ত পথের ঠিক পূর্ব দিকে রয়েছে একটি উঁচু টাওয়ার ঘড়ি। তবে সেটি এখন আর সচল নেই। একসময় এটি শব্দ করে সময় জানান দিতো। সাধারণ মানুষ এবং নদীতে চলাচলকারী নৌকা ও জালযানের মাঝি-যাত্রীদের সুবিধার জন্য এই ঘড়িটি নির্মাণ করা হয়। তাছাড়া নবাব বা ইংরেজ শাসকরা এলে ঘন্টাও বাজানো হতো এখানে।
বাচ্চাওয়ালি কামান: হাজারদুয়ারী প্রাসাদের ঠিক উত্তর দিকে মাঠের মধ্যে বসানো রয়েছে নাবাবী আমলের বিশাল এক কামান বা তোপ। এটিকে বাচ্চাওয়ালী কামানও বলা হয়। নবাব হুমায়ুনজার সময় এটি ভাগীরথী নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। ১৬৪৭ সালে ঢাকার বিখ্যাত কর্মকার জনার্দন কর্মকার এটি তৈরি করেন। জাহান কোষা কামানটিও তিনিই তৈরি করেছিলেন। কামানটির দৈর্ঘ ১৮ ফুট ও প্রস্থ ২২ ইঞ্চি। এর ওজন আনুমানিক সাত হাজার ৬শ ৫৭ কেজি। জাহান কোষা কামান ছিলো মুর্শিদকুলি খাঁর। আর বাচ্চাওয়ালী কামানটি হচ্ছে সুলতান ইলিয়াস্ শাহর। এটিতে ১৮ কেজি বারুদ লাগতো। কথিত রয়েছে, এই কামান একবারই শুধু দাগা হয়েছিল। এর তীব্র আওয়াজে তখন বহু গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত ঘটে। সেই থেকে এর নাম দেয়া হয় বাচ্চাওয়ালি কামান বা তোপ। এর পর কামানটি আর ব্যবহার হয়নি।
ইমামবাড়া: হাজারদুয়ারী রাজপ্রাসাদের ঠিক সামনেই রয়েছে আরেকটি পর্যটন আকর্ষণ ইমামবাড়া। ২০৭ মিটার দীর্ঘ ভারতের সবচেয়ে বড় ইমামবাড়া এটি। বলা হয়, প্রথমে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কাঠ দিয়ে নির্মাণ করেন এই ইমামবাড়া। নামি-দামি বিভিন্ন বস্ত্র দিয়ে এটি অলংকৃত করেন সিরাজ উদ দৌলা। নবাবী আমলে ধর্মীয় উৎসবে বর্ণিল সাজে সজ্জিত করা হতো এই ইমামবাড়া। এরপর কেটে যায় ১শ’ বছর। ১৮৪৬ সালে একবার আগুন লেগে ইমামবাড়াটি পুড়ে যায়। তখন বাংলা ব্রিটিশদের দখলে। মসনদে তাদেরই অধিনত নবাব হুমায়ুনজার ছেলে নবাব নাজিম মনসুর আলী। ১৮৪৭ সালে মনসুর আলী ফেরাদনজা প্রায় ৭ লাখ রুপি ব্যয়ে বর্তমান ইমামবাড়াটি পুনঃনির্মাণ করেন। মহররম মাসের ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত ইমামবাড়াটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। তখন উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে আসেন। মহররম মাসের শেষ দিন সকাল বেলা এখান থেকে একটি শোভাযাত্রা বের করা হয়। এছাড়া বছরের অন্য সময় এটি বন্ধ থাকে।##
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।